বাংলাদেশ ও ভারত দক্ষিণ এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং এ দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পর আজকের বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান হিসাবে পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের অংশ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসনের নিষ্পেষণে নিষ্পেষিত হয়ে পূর্ব বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তখন ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তার সরকার যে সহায়তা করেছিল তা বাংলার মানুষ কখনো ভুলবে না।
প্রায় এক কোটি পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া এবং সামরিক সহায়তা প্রদানসহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মিসেস গান্ধী যে ভূমিকা রেখেছিলেন সেটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছিল। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ থেকে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে ফেরত নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মিসেস গান্ধী যে উদারতা দেখিয়েছিলেন তা নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের ক্ষেত্রে খুব কমই দেখা যায়।
স্বাধীনতার সময় থেকে দুটি দেশ যে ঐক্যের ভিত্তিতে নিজেদের সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে চলেছে তা আজ পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে। তবে মাঝে কিছুটা সময় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নেতিবাচক সম্পর্ক বিরাজমান থাকলেও গত ১২ বছরে দুটি দেশের সম্পর্ক একটি বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছেছে। ছিটমহল সমস্যার সমাধানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান এসেছে গত ১২ বছরে। বিভিন্ন প্রকল্পে ভারতের সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়েছে।
বার্ষিক ভিত্তিতে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ৪৬ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ভারতের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩.১৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার। অর্থাৎ এ সময়কালে বহির্বিশ্বে ভারতীয় রপ্তানির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল চতুর্থ। বাংলাদেশের আগে ছিল যুক্তরাষ্ট্র (১৫.৪০ বিলিয়ন ইউএস ডলার), চীন (৫.৯২ বিলিয়ন ইউএস ডলার) এবং ইউএই (৫.৩৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার)।
এ পরিসংখ্যান থেকে যে বিষয়টি পরিষ্কার সেটি হলো দুই দেশের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। তবে ভারতের রপ্তানি বাংলাদেশে বাড়লেও বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। তবে ২০১১ সাল থেকে ২৫টি পণ্য ব্যতীত বাংলাদেশের পণ্যের ভারতীয় বাজারে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা দেওয়ার ভারত সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা হলেও কমেছে। তারপরেও সম্পর্ক উন্নয়নে দুই দেশের সরকার প্রধানের উচিত এ বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে নিয়ে আসার জন্য ঐকমত্যে পৌঁছান।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক দল যেমন ভারতে তাদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম প্রদর্শন করে, ঠিক তেমনিভাবে ভারতীয় সংস্কৃতিক দল প্রায়শই বাংলাদেশের মানুষের সামনে তাদের কার্যক্রম উপস্থাপন করে। এর মাধ্যমে দুই দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একটি শক্তিশালী সেতুবন্ধ রচিত হয়েছে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, বাংলাদেশ ও ভারত উপমহাদেশের দুটি রাষ্ট্র হওয়ার কারণে দুই দেশের সাংস্কৃতিক জগতের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে বিধায় আবহমান কাল থেকে উভয় দেশ সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
দুই দেশের সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য ভারত সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য যে বৃত্তি চালু করেছে সেটি দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলেছে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস-এর আওতায় বৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটি সেক্টরে ভারত সরকার বৃত্তি চালু করেছে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো মৈত্রী বৃত্তি, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য বৃত্তি এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু চেয়ার বৃত্তি। বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রতিবছর চিকিৎসার কারণে ভারতে ভ্রমণ করার ফলে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা ইতিবাচক বার্তা প্রদান করে।
এ ছাড়াও আঞ্চলিক আন্তঃদেশীয় রোড যোগাযোগ চালু করার বিষয়টি উভয় দেশের সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। এই যোগাযোগ শুরু হলে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হবে। এটি চালু হলে শুধু ভারত নয়, আমাদের আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গেও বাংলাদেশের বাণিজ্যের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বলে ধারণা করা হয়। অনেকে আন্তঃদেশীয় রোড যোগাযোগকে নেতিবাচকভাবে দেখা করার চেষ্টা করেন এই যুক্তিতে যে, বাংলাদেশ তাহলে ভারতের করিডর হয়ে যাবে।
এ ধরনের যুক্তি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কারণ বিশ্বায়নের যুগে এ ধরনের প্রচেষ্টা যদি সার্থক হয় তবে সেটি উভয় দেশের জন্যই সুফল বয়ে আনবে। এ যোগাযোগের সঙ্গে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য এবং ভিসামুক্ত ভ্রমণ সুবিধা প্রদান করা হলে উভয় দেশ যেমন লাভবান হবে, একইসঙ্গে দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে যেমনটি আমরা ইউরোপে দেখতে পাই। স্যাঙ্গেন ভিসার আওতায় ইউরোপের অনেক দেশে প্রবেশ করা যায়।
এখানে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশ এবং ভারত সরকার স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল পদ্মার পানি বণ্টন চুক্তি, ছিটমহল সমস্যার সমাধান এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা। তবে দুটি দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর হলেও বেশ কয়েকটি বিষয়ে এখন পর্যন্ত ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এবং বর্ডারে হত্যা।
তিস্তার পানি চুক্তির ব্যাপারে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ইতিবাচক মনোভাব থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতার কারণে তা করা সম্ভব হচ্ছে না এই মর্মে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বিবৃতি প্রদান করলেও আমাদের সবার মনে রাখা উচিত দুই দেশের সম্পর্ককে উন্নত করতে হলে ভারত সরকারের উচিত যে কোনো প্রক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটিয়ে এই চুক্তি সম্পন্ন করা। এই চুক্তি হলে তা শুধু দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে না, তিস্তার পানির অভাবে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জনগণকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয় তা কিছুটা হলেও লাঘব হবে।
অন্যদিকে বর্ডারে হত্যা সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য দুটি দেশের উচ্চপর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা হলেও সময়ের ব্যবধানে মাঝে মাঝে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড দুটি দেশের সম্পর্ককে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে পারে বিধায় এ হত্যাকাণ্ড কমানো উচিত।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এতটা মজবুত ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে আছে যে, পৃথিবীর অনেক দেশ এ সম্পর্ককে ঈর্ষা করতে শুরু করেছে। বিভিন্ন মোড়লরা চেষ্টা করছেন এ সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরানোর জন্য। উভয় দেশের সরকারপ্রধানদ্বয়ের উচিত এ বিষয়টিতে সচেতন থাকা।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের সম্পর্কটা অনেক মজবুত ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং, যেসব বিষয়ে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি, সে বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছানোর মাধ্যমে এ সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ই হতে পারে এবারের মৈত্রী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য।
লেখক: ড. প্রণব কুমার পান্ডে
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর