২ হাজার ২০০ পিস ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন শহিদুল্লাহ খান নামের এক ব্যক্তি। এসংক্রান্ত মামলায় নিম্ন আদালতে জামিন চেয়ে ব্যর্থ হন তিনি। যান উচ্চ আদালতে। সেখানে দায়েরকৃত জামিন আবেদনে বদলে দেন মামলার মূল এজাহার ও চার্জশিট। ঐ এজাহারে ২ হাজার পিস ইয়াবার স্থলে মাত্র ২০ পিস ইয়াবা উদ্ধার দেখানো হয়। মেলে জামিনও। উচ্চ আদালতের জামিননামা দাখিল করলে জালিয়াতির বিষয়টি নজরে আসে গোপালগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের। তিনি জালিয়াতির বিষয়ে একটি প্রতিবেদন হাইকোর্টে পাঠান। এরপর জামিনদানকারী হাইকোর্টের বেঞ্চের নজরে আনা হলে স্থগিত করা হয় জামিন। জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তলব করা হয় ঐ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের নকল শাখার তিন কর্মচারীকে। আগামী সপ্তাহে হাইকোর্টে হাজির হয়ে তাদের লিখিত ব্যাখ্যা দাখিল করতে বলা হয়েছে।
শুধু মাদক মামলাই নয়, জাল নথি তৈরির পাশাপাশি তথ্য গোপন ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অস্ত্র, হত্যা, ধর্ষণ মামলাসহ বিভিন্ন গুরুতর ফৌজদারি মামলায় উচ্চ আদালত থেকে হাসিল করা হচ্ছে জামিন। জালিয়াতি চক্রের এই বেপরোয়া আচরণের বিষয়টি হাইকোর্টের বিচারপতিদের নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে আসামির জামিন বাতিলের পাশাপাশি দেওয়া হচ্ছে মামলা দায়ের ও তদন্তের নির্দেশ।
প্রায় অর্ধশত জামিন জালিয়াতির ঘটনায় হাইকোর্টের পৃথক পৃথক বেঞ্চের দেওয়া নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হলেও তার তদন্ত ও বিচারে দৃশ্যমান অগ্রগতি কতটুকু, সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন তারা। এ পর্যন্ত এ ধরনের কতটি মামলা নিষ্পত্তি বা কতজনের সাজা হয়েছে, সেই সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই তাদের কাছে। সম্প্রতি জালিয়াতি করে জামিন হাসিলের কয়েকটি মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখতে পাওয়া যায় যে বেশির ভাগ জামিন জালিয়াতির ক্ষেত্রেই মামলার মূল এজাহার, পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন, জব্দ তালিকা এমনকি অধস্তন আদালতের রায় ও আদেশও পালটে দেওয়া হয়েছে। এ কাজে জড়িত চক্রে সবার আগেই উঠে আসে মামলার তদবিরকারকের নাম। রয়েছে কিছু অসাধু আইনজীবী ও আইনজীবীর সহকারীর নামও। নতুন করে উঠে এসেছে দুই কারারক্ষীর নামও। রয়েছে কোর্টের বিভিন্ন শাখার কিছু অসত্ কর্মচারীও।
গত সপ্তাহে দুটি জামিন জালিয়াতির মামলা পরিচালনায় এক আইনজীবীর নাম আসায় বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ বলে, বলুন তো এ ধরনের ঘটনায় আইনজীবী হিসেবে কেন আপনার নাম বারবার আসছে? তখন ঐ আইনজীবী দাবি করেন, তিনি জালিয়াতি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। হাইকোর্ট তদন্তের নির্দেশ দিয়ে বলেছে, জালিয়াতির ঘটনায় আইনজীবী জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
চলতি মাসে হাইকোর্টে কয়েকটি জামিন জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। এতে বিস্ময় প্রকাশ করেন বিচারপতিরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ধর্ষণ মামলার রায় পালটে দিয়ে জামিন আবেদনের ঘটনা। নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, মামলায় আসামি কবির বিশ্বাসের যাবজ্জীবন সাজা হয়। কিন্তু তিনি দুই কারারক্ষী ও মামলার তদবিরকারকের সহযোগিতায় রায়সহ মামলার সব মূল নথি পালটে যাবজ্জীবন সাজার স্থলে সাত বছর দেখিয়ে জামিন চান। জালিয়াতির বিষয়টি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী হাইকোর্টের নজরে আনলে দুই কারারক্ষীসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের নির্দেশ দেয় বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ।
এই জালিয়াতি উদ্ঘাটনের রেশ মিলিয়ে না যেতেই অস্ত্র মামলার এজাহার পরিবর্তন করে জামিন হাসিল করেন ১৭ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আব্দুস সাত্তার। জালিয়াতির বিষয়টি নজরে আসায় জামিনদানকারী বেঞ্চ আসামির জামিন বাতিলের আদেশ দেয়।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল ইত্তেফাককে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীর পক্ষে জাল নথি যাচাই করা সম্ভব নয়। এ কারণে অনেক সময় আইনজীবীরাও এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছেন। মামলা এফিডেভিট ও ফাইলিংয়ের ক্ষেত্রে যদি তদবিরকারকের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়, তাহলে জালজালিয়াতি কমে যাবে। কারণ যারা এই জালিয়াতি করেন, তারা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এটা করে থাকেন। বারের পক্ষ থেকে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার, জালিয়াতির ঘটনায় কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। জালিয়াতির সর্বশেষ ঘটনাটি উদ্ঘাটিত হয় বৃহস্পতিবার। ঐ মামলায় নথি জাল করে গত মার্চ মাসে হাইকোর্ট থেকে জামিন পান আসামি শহীদুল্লাহ। জালিয়াতির ঘটনা উদ্ঘাটনের পর হাইকোর্ট তলব করে আসামির আইনজীবী মোস্তফা কামালকে। আইনজীবীর উদ্দেশে হাইকোর্ট বলে, জালিয়াতির পেছনে যত ক্ষমতাধর ব্যক্তিই থাকুক না কেন, কোর্টের সঙ্গে প্রতারণায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না।
Source/ইত্তেফাক