জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শে উন্নত, সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা গড়ার শপথ নিল বাঙালি জাতি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে মহান বিজয় দিবসে দেশবাসীকে এ শপথবাক্য পাঠ করান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
‘সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের শপথ’ শিরোনামের শপথবাক্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতি প্রতিষ্ঠা করেছে তার স্বতন্ত্র জাতিসত্তা। আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিববর্ষের বিজয় দিবসে দৃপ্তকণ্ঠে শপথ করছি যে, শহিদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। দেশকে ভালোবাসব। দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শে উন্নত, সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা গড়ে তুলব। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের সহায় হোন।’
বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৪টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে ‘মহাবিজয়ের মহানায়ক’ শিরোনামে এ বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। শপথবাক্য পাঠ করার আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে নিহত, জাতীয় চার নেতা এবং সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিহতদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ (বৃহস্পতিবার) ১৬ ডিসেম্বর ২০২১। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দিন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রাম ও যুদ্ধের মধ্য দিয়েই আমরা অর্জন করি, যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু পরিচালনা করেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার আদায়ের জন্য বঙ্গবন্ধু তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পুরো পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু বাঙালি জাতি পাকিস্তান শাসন করবে, এটা পাকিস্তানি সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান মেনে নিতে পারেনি। তাই বাঙালিদের ওপর শুরু করে নিপীড়ন-নির্যাতন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলাদেশের মানুষকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রতি জেলা, মহকুমা, থানা ও গ্রামে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। শুরু হয় এই আন্দোলন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য উদ্ধৃতি দিয়ে তার কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাংলাদেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে শুরু করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্য রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্থানে আক্রমণ করে গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই রাতেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি সেই ঘোষণায় বলেন, ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছো, যাহার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও। সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ শত্রুটিকে বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তার (বঙ্গবন্ধুর) এই স্বাধীনতার ঘোষণা ঢাকার পিলখানায় তৎকালীন ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে প্রেরণ করা হয়। পূর্ব থেকেই ইপিআরের সুবেদার মেজর শওকত আলী তিনজন সহযোগীসহ সেখানে অপেক্ষারত ছিলেন। এই বার্তা বাংলাদেশের সব পুলিশ স্টেশন, থানায় পৌঁছে যায়। সেখানে কর্মরত অফিসাররা এই বার্তা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের হাতে ভোরের মধ্যেই পৌঁছে দেন। একই সঙ্গে টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টারেও এই বার্তা সারা দেশে পৌঁছে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হেঁটে মুখে চোঙা ফুঁকিয়ে অথবা রিকশায় করে মাইকযোগে সারা দেশে এই বার্তা প্রচার করতে শুরু করেন। তারা জেলা থেকে থানা পর্যন্ত এই বার্তা প্রচার এবং সেই সঙ্গে প্রচারপত্র তৈরি করেও বিলি করেন। ২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা প্রথম পাঠ করেন। এরপর একে একে অন্য নেতারাও বারবার এই ঘোষণা পাঠ করতে থাকেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রেডিও, টেলিভিশন ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে শুরু করে, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের পাশে দাঁড়ায় প্রতিবেশী দেশ ভারত, রাশিয়াসহ অন্যান্য বন্ধুপ্রতিম দেশ ও তাদের জনগণ। মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে বাঙালিরা পরাজিত করে। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় আমাদের বিজয়। দেশবাসীর উদ্দেশে সরকারপ্রধান বলেন, আসুন এই বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিববর্ষে আমরা শপথ গ্রহণ করি। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে সোনার বাংলা হিসাবে গড়ে তোলা এবং বিশ্বে উন্নত-সমৃদ্ধ বিজয়ী জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করে চলার জন্য আমরা শপথ নেব।
এরপর প্রধানমন্ত্রী সবাইকে শপথ পাঠ করান। সবাইকে নিয়ে শপথ পাঠ করে সব মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে বক্তব্য শেষ করেন।
এর আগে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শপথবাক্য পাঠ করানোর সময় পাশে তার ছোট বোন শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। শপথবাক্য-পর্ব সঞ্চালনা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। শপথ গ্রহণকারীদের হাতে ছিল লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা। প্রধানমন্ত্রী শপথ পড়ানোর পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, সাংস্কৃতিক সংগঠন সুরের ধারা ও হাল আমলের শিল্পীদের পরিবেশনায় ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আরেকটি নাম মুজিবর’ গানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের শপথপর্ব শেষ হয়।
সংক্ষিপ্ত বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় পর্বে শুরু হয় আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, বিজয় দিবসের ৫০ বছর পূর্তিতে আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ওইসব বন্ধুপ্রতিম দেশ, সংস্থা এবং ব্যক্তির প্রতি, যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে খাদ্য, অর্থ, অস্ত্র ও মানবিক সাহায্য এবং নৈতিক সমর্থন দিয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমাদের নিকট প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের কথা বিশেষভাবে না বললেই নয়। ভারত আমাদের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে অনন্য মানবিক নজির স্থাপন করেছিল।
তিনি আরও বলেন, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, তার সরকার, ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থার কর্মী, লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র দিয়ে, প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের যুদ্ধের জন্য তৈরি করেছিলেন। সবশেষে মিত্রবাহিনীর সদস্য হিসাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বেশ কিছু সংখ্যক ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য শহিদ হয়েছিলেন। আমি আজকে তাদের গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি। সশস্ত্র বাহিনীর শহিদ সদস্যদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ সম্মানিত অতিথি হিসাবে এই গৌরবগাথার দিনে আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন। আমি তার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তার স্ত্রী ও মেয়েও উপস্থিত হয়েছে, আমি তাদেরও স্বাগত জানাই।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০২০ সালের জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের আয়োজন করি। কিন্তু দুর্ভাগ্য করোনাভাইরাস আমাদের সেই কর্মসূচি ব্যাহত করে। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের অনুষ্ঠান ২০২১ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের সঙ্গে একযোগে পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করি। আমরা মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করি। ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদিসহ সার্কভুক্ত ৫টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানগণ সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানমালায় যোগ দিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার রাজনীতিই হলো শোষিত মানুষের জন্য। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি তার সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশের মানুষের জন্য। বাংলাদেশের একেবারে তৃণমূলের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি একটি বিষয়ে লক্ষ্য রেখেছেন- এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হবে। ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হবে। এই লক্ষ্য সামনে নিয়েই তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। এ সময় ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ৬-দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, একটি জাতির জন্য একজন নেতা কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন বঙ্গবন্ধু তার দৃষ্টান্ত।
শেখ হাসিনা বলেন, ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা দেশে ফিরে আসেন। যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ার কাজে নিয়োজিত হলেন। গ্রামের তৃণমূলের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দ্বিতীয় বিপ্লবের উদ্যোগ নিলেন তখনই জাতির পিতাকে হত্যা করা হলো। আমি ও আমার ছোট বোন রেহানা বিদেশে ছিলাম বলে বেঁচে যাই। কিন্তু আমার পরিবারের সব সদস্যকেই হত্যা করে। এরপর বাংলাদেশে ১৯টা ক্যু হয়। একটা পরিবেশ। হাজার হাজার সামরিক বাহিনীর অফিসার ও মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা ছয় বছর বিদেশে রিফিউজি হিসাবে ছিলাম। ১৯৮১ সালে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসি। তার পর থেকেই চেষ্টা করেছি জাতির পিতার আদর্শে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, নারী নির্যাতন ও মাদক নির্মূলে আমাদের সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা দেশের মানুষের শান্তি চাই। উন্নত সমৃদ্ধ জীবন চাই। তিনি বলেন, এ উৎসব শুধু উৎসব নয়, এটা আমাদের আগামী দিনের চলার পথের প্রতিজ্ঞা। বাংলাদেশকে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত সমৃদ্ধ, সোনার বাংলা হিসাবে ইনশাআল্লাহ গড়ে তুলব।
এদিকে আলোচনা পর্বে যোগ দিতে বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান। এ সময় তাকে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সঙ্গে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। অতিথিরা অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছলে পরিবেশন করা হয় জাতীয় সংগীত। এরপর বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে অংশবিশেষ পাঠ করা হয়। আলোচনা পর্বে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। আবদুল হামিদ তার বক্তব্যে বলেন, স্বাধীনতার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সবাইকে সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
সম্মানীয় অতিথি হিসাবে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। বাংলায় বাংলাদেশের মানুষকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানিয়ে বিশেষ অতিথির বক্তব্যের শুরুতে রামনাথ কোবিন্দ বলেন, ‘নমস্কার, শুভসন্ধ্যা, আসসালামু আলাইকুম। আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই।’
শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন-মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং স্বাগত বক্তব্য দেন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা সম্মানীয় অতিথির হাতে তুলে দেন ‘মুজিব চিরন্তন’ শ্রদ্ধা স্মারক। এরপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশিত দুটি স্মারকগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে জাতীয় পতাকা হাতে আটটি বিভাগীয় শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সর্বস্তরের মানুষ এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। আলোচনা পর্ব শেষে ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তর শিল্পীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। অনুষ্ঠান চলে রাত ৮টায় পর্যন্ত।
এদিকে দুদিনের আয়োজন ঘিরে লাল-সবুজের থিমে বর্ণিলভাবে সাজানো হয়েছে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা। সংসদ ভবনকে পেছনে রেখে মঞ্চ সাজানো হয়েছে। সংসদ ভবনে ফুটে উঠেছে মুজিব শতবর্ষের লোগো এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর লোগো। ‘মহাবিজয়ের মহানায়ক’ অনুষ্ঠান ঘিরে সংসদ ভবন এলাকায় বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। আমন্ত্রিত অতিথিদের পাশাপাশি উৎসুক অনেক সাধারণ মানুষও পরিবার নিয়ে রাজধানীর মানিক মিয়া এভিউনিউয়ে ঘুরতে যান। সঙ্গে করে এনেছিলেন জাতীয় পতাকা। তবে শুধু আমন্ত্রিত অতিথিরা সংসদ ভবনের ভেতরে নিরাপত্তা তল্লাশির মাধ্যমে প্রবেশের সুযোগ পান। অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে মানিক মিয়া এভিনিউর দুই পাশেই সাধারণ যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিল। শুধু অনুষ্ঠানের জন্য সরবরাহকৃত স্টিকারযুক্ত গাড়ি প্রবেশ করতে পেরেছে। প্রধান সড়কের ওপর গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
সেনাবাহিনী : ঢাকা সেনানিবাসস্থ আর্মি স্টেডিয়ামে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে নতুন প্রজন্মসহ সবাইকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শিখায় আলোকিত এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা থেকে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায়, বর্ণাঢ্য আয়োজনে এবং যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক ঢাকা, মিরপুর ও পোস্তগলা সেনানিবাসের প্রায় ১০ হাজার অফিসার, জেসিও ও অন্যান্য পদবির সৈনিক প্রধানমন্ত্রীর পরিচালনায় আর্মি স্টেডিয়ামে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শপথগ্রহণে অংশগ্রহণ করেন। সদর দপ্তর লজিস্টিকস এরিয়ার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়।
নৌবাহিনী : বিকালে প্রধানমন্ত্রী পরিচালিত বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে নৌবাহিনীর ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা নৌ অঞ্চলের জাহাজ ও ঘাঁটির সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও নৌসদস্য অংশগ্রহণ করেন। পাশাপাশি নৌবাহিনী স্কুল ও কলেজসমূহের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থেকে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে।
বিমানবাহিনী : এদিন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সব কর্মকর্তা, বিমানসেনা ও অন্যান্য সদস্য বিমানবাহিনী ঘাঁটি বাশারের প্যারেড গ্রাউন্ডে সমবেত হয়ে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা হতে সরাসরি সম্প্রচারিত শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে শপথবাক্য পাঠ করেন। এছাড়াও বিমানবাহিনীর সব ঘাঁটি ও ইউনিটসমূহের সদস্যরা উক্ত শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে শপথবাক্য পাঠ করে মুজিববর্ষকে স্মরণীয় করে রাখে।
জাতীয় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ : জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে ভার্চুয়ালি শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক নেতারা। অনুষ্ঠানে জাতির পিতা ও শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এ সময় বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল বাহার মজুমদার টিপু বলেন, দুঃখের বিষয় আজকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে দাওয়াত না পেয়ে প্রেস ক্লাবে বসে ভার্চুয়ালি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হচ্ছে। অন্য দিকে আমলা ও নামধারী মুক্তিযোদ্ধারা বড় আসন অলংকৃত করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান করছে। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল নির্বাচন প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান মো. আব্দুল হাইয়ের সভাপতিত্বে এ সময় উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবি সিদ্দিক মোল্লা, বিএলএফ মুজিব বাহিনীর কমান্ডার জয়নাল আবেদীন খন্দকার, কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেন, মহিলা কমান্ডের সভাপতি পারভিন রশীদ, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নয়ন, শাহনাজ পারভিন এলিস ও আমিনুল ইসলাম রিপন প্রমুখ।