ইউনিভার্স ট্রিবিউন অনলাইন ডেস্ক প্রকাশিত: ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১৩:৪২ | আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১৩:৫১
বাংলাদেশে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সরকারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেধে চলা এবং দলটির এক সময়ের শক্ত ঘাঁটি উত্তরাঞ্চলে ক্রমশ শক্তি হারানোর পথে থাকা জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আর কতটা প্রাসঙ্গিক? এ প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।
অথচ জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলের আসনেই আছে দলটি। যদিও দলের দ্ ুঅংশের বিরোধের জের ধরে দলীয় প্রধান জি এম কাদের আদালতের এক আদেশের কারণে কাজ করতে পারছেন না।
আবার সংসদেও দলটির কোনো সদস্য সরকারের প্রশংসা করছেন আবার কেউ সরকারের বিরোধিতা করছেন। এমনকি দলের অভ্যন্তরে বড় সংকট এলে দলটির নেতারা অনেক তাকিয়ে থাকেন খোদ সরকারের উচ্চপর্যায়ের দিকে- এমন খবরও আসে গণমাধ্যমে।
যদিও দেশের প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একসময় জাতীয় পার্টিকে নিজেদের সঙ্গে ভেড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে- এমন চিত্র বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছিলো বহু বছর ধরেই।
সামরিক শাসক ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর ক্ষমতায় থেকে দলটি গঠন করেছিলেন।
১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে তার পতন হলেও জেলে থেকেই এরশাদ দলটির প্রত্যাবর্তনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে এরশাদ নিজেও পাঁচটি আসনে জয়লাভ করেন এবং তার দলও ৩৫টি আসন পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল।
অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এবং দুর্নীতির দায়ে জেল খেটেও জেনারেল এরশাদ প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতা এবং ভোটের রাজনীতিতে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখতে পেরেছিলেন।
কিন্তু তার মৃত্যুর পর দলটি একেবারেই গুরুত্ব হারিয়েছে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। দলের নেতারা অবশ্য এটি মানতে রাজি নন। দলের মহাসচিব মুজিবুল হক বলছেন ব্যক্তি।
এরশাদ তার দলের জন্য বড় সম্পদ ছিলেন এবং তার না থাকাটা বড় ক্ষতি হলেও দল হিসেবে জাতীয় পার্টি আগের মতোই রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ।
‘নির্বাচন আসলেই দেখবেন। মানুষ প্রধান দল দুটির শাসন দেখেছে। আমরাও সংগঠিত হচ্ছি,’ বলছিলেন তিনি।
কীভাবে গুরুত্ব হারালো জাতীয় পার্টি
একানব্বই সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ জেলে থেকেই নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং দলটি ৩৫টি আসন পেয়েছিলো। তার পর থেকে দীর্ঘ সময় রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে দলটির শক্ত অবস্থান ছিল।
জাতীয় পার্টি ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে সরাসরি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট থেকেই অংশ নিয়েছিল। তবে তার আগে অনেক নাটকীয়তা হয়েছে দলটিকে ঘিরে।
দলটির তখনকার নেতা এরশাদ কখনো বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট আবার কখনো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের দিকে আসা যাওয়া করছিলেন।
তবে ওই নির্বাচনের পর থেকে ভোটের রাজনীতিতে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগের মিত্র হিসেবেই ছিলেন জেনারেল এরশাদ এবং তাঁর দল জাতীয় পার্টি।
এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনেও – জেনারেল এরশাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও- জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে হয়েছিল। সে সময় দলটির নেতাদের অনেকের কথায় সেই অস্বস্তির কথা চাপা থাকেনি। সে সময়েও দলটিকে ঘিরে নানা ধরনের তৎপরতা দেখা গিয়েছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে।
সর্বশেষ একাদশ সংসদেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে জাতীয় পার্টি ২২টি আসন নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসেছে।
কিন্তু ২০১৪ সালের পর প্রধান বিরোধী দল হলেও দলটির কয়েকজন নেতা মন্ত্রী ছিলেন যা রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক সময় হাসি তামাশারও খোরাক হয়েছিল।
আবার জেনারেল এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশাকে ঘিরেও মাঝেমধ্যে নানা ঘটনায় বিব্রত হয়েছে দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা।
জেনারেল এরশাদের মৃত্যুর পর তার ভাই জি এম কাদের নেতৃত্ব পেলেও রওশন এরশাদ ও তার মধ্যকার বিরোধ মাঝেমধ্যেই তীব্র সংকটে রূপ নিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাতীয় পার্টির রাজনীতির পর্যবেক্ষক শাহজাহান সরদার বলছেন, রংপুর অঞ্চলে দলটির শক্ত অবস্থান এখন আগের মতো যেমন নেই তেমন ময়মনসিংহ ও সিলেট এলাকাতেও দুর্বল হয়ে গেছে দলটি।
‘জাতীয় পার্টি যেসব এলাকায় শক্তিশালী হয়েছিল সেগুলো আগে আওয়ামী লীগের ছিলো। গত দেড় দশকে অনেক নেতাই আবার আওয়ামী লীগে ফিরে গেছেন। এমনকি রংপুর অঞ্চলেও জাতীয় পার্টির অনেক আসন এখন আওয়ামী লীগের,’ বলছিলেন তিনি।
তার মতে এককভাবে দেশজুড়ে নির্বাচনের সক্ষমতাই এখন জাতীয় পার্টির নেই বরং আলাদা নির্বাচন করলে হাতে গোনা কয়েকটি আসনের বাইরে দলটিকে খুঁজে পাওয়াই কষ্টকর হবে।
‘অনেক দিন ধরে সরকারের সাথে থাকা এবং বিরোধী দল হিসেবে কার্যকর না হওয়া ছাড়াও অভ্যন্তরীণ বিবাদ দলটির বড় সমস্যা। অনেক নেতাই দল ছেড়েছেন। অনেকে এমপি হয়েছেন আওয়ামী লীগের সমর্থনে। আলাদা নির্বাচন করলে তারা জিতবেন না।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলছেন, জাতীয় পার্টি একটি ক্ষয়িষ্ণু শক্তি, যার রাজনৈতিক অঙ্গনে এককভাবে কিছু করার ক্ষমতা নেই।
তিনি বলছেন, অনেক দিন ধরেই দলটি মূলত একটি আঞ্চলিক দল কিন্তু সেটিও তারা ধরে রাখতে পারেনি।
‘রাজনীতিতে পার্থক্য বা প্রভাব রাখার সক্ষমতা জাতীয় পার্টির নেই। বিদিশা, রওশন এরশাদ আর জিএম কাদের তিনজনকে ঘিরে আলাদা বলয় আছে যারা একে অপরের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু সবাই আবার সরকারের সঙ্গে থেকে কিছু পেতে চান। এভাবে রাজনীতিতে অবস্থান রাখা যায় না,’ বলছিলেন তিনি।
শাহজাহান সরদার অবশ্য বলছেন, স্থির কোনো নীতি না থাকলেও কয়েকটি আসন পেলেও নির্বাচনের পর ক্ষমতায় যাওয়ার দৌড়ে থাকার দলগুলোর মধ্যে আসন পার্থক্য বেশি না হলে জাতীয় পার্টির গুরুত্ব বাড়বে।
‘তবে এটি নির্ভর করবে কোনো প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কীভাবে ও কেমন হয় তার ওপর। আপাতদৃষ্টিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে মনে হচ্ছে। ভবিষ্যতে কী হবে এখনই বলা কঠিন। কিন্তু এককভাবে ভোট করলে কোনো পরিস্থিতিতেই খুব বেশি আসনে জেতার সামর্থ্য তাদের নেই। তবে কয়েকটি আসন পেলেই ক্ষমতায় যাওয়ার দৌড়ে থাকা দলগুলোর কাছে জাতীয় পার্টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে,’ বলছিলেন মি. সরদার।
জাতীয় পার্টি যা বলছে
দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক বলছেন, গত দুই বা তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে নির্বাচন করায় জনমনে তার দলকে নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে তবে তারা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাননি বলেই মনে করেন তিনি।
‘দেখুন এত কিছুর পরেও অনেক জায়গায় জাতীয় পার্টি শক্তিশালী। আমরা দলকে আরও সংগঠিত করছি। এরশাদের মতো দেশব্যাপী জনপ্রিয় না হলেও জি এম কাদের সজ্জন ও অভিজ্ঞ রাজনীতিক হিসেবে সুপরিচিত। তার নেতৃত্বে দল সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুত হচ্ছে। রওশন এরশাদের সাথে বিবাদও মিটে গেছে,’ বলছিলেন তিনি।
মুজিবুল হক মনে করেন নির্বাচনে সব দল আলাদাভাবে অংশ নিলে তার দলই হয়ে উঠবে রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক দল।
খবর বিবিসি বাংলার