ঢাকা :
ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে বাবার কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তার দাফন সম্পন্ন হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দেশবরেণ্য এই শিক্ষাবিদের দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আল মারকাজুল ইসলাম।
জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামা (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭ – ১৪ মে ২০২০) |
ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে কবরস্থ করার আগে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়।
বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
গত ২৭ এপ্রিল গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে রাজধানীর মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় শনিবার তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে চিকি’সাধীন অবস্থায় গতকাল না ফেরার দেশে চলে যান দেশবরেণ্য এই শিক্ষাবিদ। তিনি হার্টের সমস্যার পাশাপাশি কিডনি, ফুসফুস ও শ্বাসযন্ত্রের জটিলতায় ভুগছিলেন।
জাতীয় এই অধ্যাপকের মৃত্যুর পর তার ছেলে আনন্দ জামান জানিয়েছিলেন, করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ এলে শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টায় বাংলা একাডেমিতে মরদেহ নেওয়া হবে। সেখানে ঘণ্টাখানেক রাখার পর বাদ জুমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। সেখান থেকে আজিমপুরে বাবার কবরে খ্যাতিমান এই শিক্ষাবিদকে শায়িত করা হবে।
কিন্তু নমুনা পরীক্ষায় করোনা টেস্ট পজেটিভ আসায় বাংলা একাডেমিতে মরদেহ না নিয়ে সকাল ১০টার দিকে দাফন করা হয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে।
বৃহস্পতিবার (১৪ মে) এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শিক্ষক ড. আনিসুজ্জামানকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ ও অনেক স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি ছিলাম স্যারের টিউটোরিয়াল গ্রুপের শিক্ষার্থী।
আনিসুজ্জামানের মতো বিদগ্ধ ও জ্ঞানী একজন মানুষের মৃত্যুতে দেশের এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো বলে শোকবার্তায় উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। এ সময় দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে জাতীয় এ অধ্যাপকের অনন্য অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন একজন বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইমেরিটাস অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ভাষা আন্দোলন (১৯৫২), উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯) ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে তার গবেষণা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। প্রবন্ধ গবেষণায় অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি থেকে প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। শিক্ষায় অবদানের জন্য তাকে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ পদক প্রদান করা হয়। সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তাকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়।
এছাড়া তিনি ১৯৯৩ ও ২০১৭ সালে দুইবার আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃক প্রদত্ত আনন্দ পুরস্কার, ২০০৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট. ডিগ্রি এবং ২০১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক লাভ করেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।
আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম এ টি এম মোয়াজ্জেম। তিনি ছিলেন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। মা সৈয়দা খাতুন গৃহিনী হলেও লেখালেখির অভ্যাস ছিল। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। আনিসুজ্জামানরা ছিলেন পাঁচ ভাই-বোন। তিন বোনের ছোট আনিসুজ্জামান, তারপর আরেকটি ভাই।
১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি বাংলা একাডেমির গবেষণা বৃত্তি লাভ করেন। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারায ১৭৫৭-১৯১৮ বিষয়ে পিএইচডি শুরু করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের গবেষণা বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস: ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল বিষয়ে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন।