উৎসবের একটি অংশ—নৃত্যরত ফরাসি তরুণী ছবি: সংগৃহীত

‘ফসল তোলার দিন, স্বর্গের উপহার সোনালি ফসল।
নিচে বিস্তীর্ণ সুফলা জমি, ওপরে উদার আকাশ,
আমাদের ঘরগুলো ভরে যাবে নতুন ফসলে
সুখে, আনন্দে।

দূরে পাহাড়ের কাছে, দ্রাক্ষা বাগান ছাড়িয়ে
ঝরনার পাশে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হব।

ফুলে, ফলে পরিপূর্ণ শাখাটি ঝুঁকে এসে ছুঁতে চায় আমার প্রিয়ার ঠোঁট।
সেখানে আমার ভালোবাসা গচ্ছিত আছে।
প্রিয়ার হাতে হাত রেখে আমি নাচব, উত্তাল হব।
দিন শেষে আমি নতুন গমের ঘ্রাণ বুকে নিয়ে ঘুমাব, পরম সুখে।
আগামী দিনের স্বপ্নের জাল বুনব।

প্রিয়ার হাতে হাত রেখে আমি নাচব, উত্তাল হব…’

প্যারিসের অদূরে প্রোভান্স শহরে নতুন ফসল তোলার উৎসবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা
 

প্রোভান্স শহরের কেন্দ্রে গ্রামীণ লোকগীতের তালে তালে নাচছেন একদল ছেলেমেয়ে। অ্যাকর্ডিয়নের সুরের সাথে নাচিয়েদের পায়ের কাঠের জুতার তাল, লয় মিলে যাচ্ছে, ভুল হচ্ছে না মোটেই। পরনে তাঁদের পুরোনো ফ্যাশনের নানা রঙিন, ঝলমলে পোশাক। মেয়েদের পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢল নামা লেস লাগানো স্কার্ট নাচের দ্রুত তালে ঘুরছে, যেন ফুলের পাপড়ি খুলেই আবার নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। মাথায় বাহারি টুপি, তাতে বসানো আছে ছোট ছোট আরশি। সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে চারদিকে। ছেলেদের পোশাকেও আছে নানা কারুকার্য, চাকচিক্য। জোড়ায় জোড়ায় নাচের ছন্দ দ্রুততর হচ্ছে।

নতুন ফসল তোলার উৎসবে শোভাযাত্রা ছবি: প্রোভান্স পর্যটন কর্তৃপক্ষ

উৎসবের দিন; এ উৎসব ফসল তোলার। প্রতিবছর আগস্ট মাসের শেষ রোববার গ্রীষ্মের রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে শহরজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। দিনটি বেশ প্রস্তুতি নিয়ে, অনেক আয়োজন করে উদ্‌যাপন করা হয়। সকাল থেকেই চারদিকে সাজ সাজ রব। খুব ভোরে শেষ গ্রীষ্মের সূর্য তখনো লাল আভায় যতটা উজ্জ্বল, ততটাই নিস্তেজ। ক্যাফে-বারগুলোর সামনের আঙিনায় বয়স্কদের ভিড় জমে উঠেছে। মেলোডি, ক্যাফে বারের তরুণী মেয়েটি ব্যস্ত হাতে কফি পরিবেশন করে যাচ্ছে। তাঁর কপালে ইতিমধ্যে মুক্তোকণার মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। তারপরও মুখে তাঁর একচিলতে হাসি লেগেই আছে। আজ আগস্ট মাসের শেষ রোববার, উৎসবের দিন, আজ ফসল তোলার উৎসব।

প্রোভান্স, ফ্রান্সের একটি মফস্বল শহর, ছবির চেয়ে সুন্দর। প্যারিস থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার (৫০ মাইল) দক্ষিণ-পূর্বে। এক ঘণ্টার কম সময়ে পৌঁছে যাওয়া যায়। প্যারিস থেকে একটু সকাল সকাল বেরিয়ে পড়াই ভালো। তাতে রাস্তায় ভিড় কম হবে। তবে ট্রেনে করে গেলে বিশেষ সুবিধা মেলে এবং গাড়ি পার্কিংয়ের ঝামেলা থাকে না। প্রতিবছর বেশ ঘটা করে নতুন ফসল ঘরে তুলে এ উৎসবের বর্ণাঢ্য আয়োজন করা হয়। ফ্রান্সে অঞ্চলভেদে উৎসবের আয়োজন করা হয়। তবে এমন উৎসব জুনের শেষ থেকে আগস্ট মাসের মধ্যেই উদ্‌যাপন করা হয়ে থাকে।

 

ফ্রান্সে নবান্নের ঐতিহ্য ধরে রাখার কৃতিত্ব অনেকখানি প্রোভান্সের কৃষক সম্প্রদায়ের প্রাপ্য। ৪৯ বছর যাবৎ একান্ত নিষ্ঠায় এমন আয়োজন করে যাচ্ছেন তাঁরা, কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। শুধু এ বছর করোনা সংক্রমণের কারণে, এক সপ্তাহ আগেই রোববার ২৩ আগস্ট নতুন ফসল ঘরে তোলার এ উৎসব উদ্‌যাপন করা হয়।

সকাল দশটা থেকে শুরু হয় স্থানীয় কৃষকদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রি। তাঁদের কাছ থেকে তা সরাসরি কিনে নিতে গিয়ে খানিকটা আলাপ করা যেতে পারে। ক্রেতা-বিক্রেতার আলাপচারিতার বেশির ভাগই থাকে কৃষক বিক্রেতার অভিজ্ঞতার কাহিনি। চোখে দেখার সঙ্গে সঙ্গে অনেক ক্রেতা কেনার আগে রকমারি খাবার ও পানীয় চেখে দেখারও সুযোগ পাচ্ছেন। শিশুদের ভিড় জমে নানা জাতের হাঁস-মুরগি, কবুতর, তিতির, কোয়েল, বনমোরগ আর গরু, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া, গাধা এসব প্রাণী ঘিরে। তাদের উৎসাহ ও আনন্দের যেন অন্ত নেই। মা–বাবারা পরম ধৈর্যে তাদের হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন।

 

দেখতে দেখতে বেলা বাড়তে শুরু করলে বাতাসে ভেসে আসবে বারবিকিউ আর মজার খাবারের মনমাতানো ঘ্রাণ। রেস্তোরাঁগুলোতে বাড়তি ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফরাসিরা খেতে পছন্দ করে। আর খাবার সময়টা সব সময়ই একদম ঘড়ি ধরা, দুপুর বারোটা থেকে একটা, দেড়টা ছাড়াতে পারবেই না। ছুটির দিনে তারা অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে দুপুরের খাবারের স্বাদ আস্বাদন করে।

 
ফসল তোলার উৎসবে মধ্যযুগের পোশাকে সজ্জিত একটি কৃষক পরিবারছবি: প্রোভান্স পর্যটন কর্তৃপক্ষ

খানিকটা সালাদ, পছন্দমতো পানীয়, বেশ বড় এক টুকরো (৩০০ গ্রাম) রাজহাঁসের বুকের মাংস ফ্রাই, সাথে অনেকটা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং সবশেষে মিষ্টান্ন—সব মিলিয়ে গুনতে হবে ত্রিশ ইউরো। তবে সস্তা খাবারের ব্যবস্থাও আছে। অনেকেই সবুজ চত্বরে গাছের ছায়ায় পরিবারের সঙ্গে চড়ুইভাতিতে মেতেছে।

বেলা তিনটায় শুরু হয় এ উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। শহরের প্রধান সড়ক ধরে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে এগিয়ে আসে প্রাচীন সময়ের কৃষকদের পোশাক-পরিচ্ছদ পরিহিত নারী-পুরুষ, শিশুদের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। গমের শীষ, সবজি, ফল-মূল, ফুল দিয়ে সজ্জিত ট্রাক্টরের মিছিল। সঙ্গে থাকে প্রাচীনকালে ব্যবহৃত কৃষি যন্ত্রপাতি। রকমারি পোশাকের নর্তক-নর্তকীদের নাচ ও বাদ্যযন্ত্রের সুরের মূর্ছনায় আচ্ছন্ন হতে হয়। বিকেল গড়িয়ে যায়। গ্রীষ্মের সুবিধা একটাই যে সূর্য পাটে বসে অনেক বিলম্বে, সন্ধ্যা নামতে নামতে ঘড়ির কাঁটা নয়টার ঘর ছাড়িয়ে যায়। জমে ওঠে নাচ আর গানের আসর, চলে মধ্যরাত পর্যন্ত।

 

উল্লেখ্য যে, গত ২০০১ সাল থেকে এ শহর ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। সুযোগ থাকলে একফাঁকে মধ্যযুগের ভাস্কর্যের সুষমামণ্ডিত বিশাল দুর্গটি দেখা আসা উচিত। মোট ২২টি গম্বুজসহ ১ হাজার ২০০ মিটার ঘেরের এ দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১২২৬ খ্রিষ্টাব্দে এবং শেষ হয় ১৩১৮ খ্রিষ্টাব্দে। ইতিহাসসমৃদ্ধ এ দুর্গ নির্মাণে মোট ৮৮ বছর লেগে যায়। অদূরেই রয়েছে দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত সিজার টাওয়ার এবং সেন্ট-কুইরিস কলেজিয়েট চার্চ। আর শহরের পুরোনো অংশে ভূগর্ভস্থ মধ্যযুগের স্থাপনাগুলো না দেখলে আক্ষেপ করতে হবে। বিশেষ করে মধ্যযুগের পেন্ডুলাম লাগানো ঘড়িটি। ফসল তোলার উৎসবের আনন্দের সঙ্গে বাড়তি আকর্ষণ এমন স্থাপনা মনে দাগ কাটবে।

 
 
একসময় উৎসব শেষ হয়ে যায়। শেষ হয় না উৎসবের আমেজ, আবার আগামী বছরের নতুন ফসলের স্বপ্নে বিভোর হয়ে সুরের মূর্ছনায় কেউ একজন আনমনে গেয়ে ওঠে, ‘প্রিয়ার হাতে হাত রেখে আমি নাচব, উত্তাল হব।’
 
 
আরও খবর
আরও
 ইউনিভার্স ট্রিবিউন