ছবি: সংগৃহীত

সাতচল্লিশে দেশভাগের পরই পূর্ববাংলাকে (বর্তমান বাংলাদেশ) ঔপনিবেশিক অঞ্চল হিসেবে শাসন ও শোষণ করা শুরু করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী।

এ কারণেই বাঙালিরা রুখে দাঁড়ায়। শুরু হয় রাজপথে আন্দোলন। সেই আন্দোলন দমন করতে পাকিস্তানি শাসকরা জেল-জুলুম ও হত্যার পথ বেছে নেয়।

কিন্তু বাঙালিকে দমানো যায়নি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হলে পাকিস্তানের শাসকরা আরও ভয়ংকর ও হিংস্র হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তারা ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে।

ওই রাতেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এর আগে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রে দেয়া ভাষণে অত্যন্ত কৌশলে যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দেন তিনি।

সেদিনই বাঙালি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে নেয়। ২৫ মার্চ গণহত্যার পরই বাঙালি প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। সেই লড়াই ৯ মাস পেরিয়ে আসে স্বাধীনতা। বাঙালি পায় স্বাধীন ভূ-খণ্ড।

১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিন থেকেই শুরু হয় বাঙালির মুক্তির সর্বাত্মক যুদ্ধ। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী পাক হানাদারদের ওপর প্রবল বিক্রমে আক্রমণ শুরু করে।

এ আক্রমণের মুখে পড়েই পাক বাহিনী বুঝতে পারে তাদের পরাজয় আসন্ন। এ কারণেই তাদের অভিভাবক যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি হেনরি কিসিঞ্জার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি সংবলিত প্রস্তাব উত্থাপন করে। কিন্তু কাজ হয়নি।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধিতায় কিসিঞ্জারের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে এদিনই বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বৈশ্বিক স্বীকৃতির উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে স্বীকৃতির জন্য পত্র পাঠানো হয়।

এছাড়া ৪ ডিসেম্বর নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আগের দিন ভারতে আক্রমণ চালিয়ে বিপাকে পড়ে যায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। এ আক্রমণের মাধ্যমে তারা চেষ্টা করেছিল মুক্তিযুদ্ধের গতি ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতে। বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চেয়েছিল- এটা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ।

কিন্তু এটা করে পাক শাসকরা ফেঁসে যায়। তাদের প্রপাগান্ডা বিশ্বের কেউ আমলে নেয়নি। রাতে দেয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বেতার ভাষণে বাংলাদেশের প্রতি তার সমর্থন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

পূর্ব পাকিস্তান আর দখলে রাখা যাবে না এবং মুক্তিবাহিনী যে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে- সেটা পাকিস্তানিরা হাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করে। রণাঙ্গনগুলোতে ক্রমেই পরাস্ত হচ্ছিল পাক হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসররা।

এদিন যৌথবাহিনীর অভিযান শুরু হয় চারটি অঞ্চল থেকে। এগুলো হল- পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে তিন ডিভিশনের সমন্বয়ে গঠিত ৪র্থ কোর সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-নোয়াখালী অভিমুখে।

উত্তরাঞ্চল থেকে দুই ডিভিশনের সমন্বয়ে গঠিত ৩৩তম কোর রংপুর-দিনাজপুর-বগুড়া অভিমুখে। পশ্চিমাঞ্চল থেকে দুই ডিভিশনের সমন্বয়ে গঠিত দ্বিতীয় কোর যশোর-খুলনা-কুষ্টিয়া-ফরিদপুর অভিমুখে। এছাড়া মেঘালয় রাজ্যের তুরা থেকে আরেকটি বাহিনী জামালপুর-ময়মনসিংহ অভিমুখে।

যৌথ বাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে সীমান্তবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রগুলো থেকে পাক বাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। একে একে পতন হতে থাকে তাদের ঘাঁটি। একপর্যায়ে অল্প কিছু জায়গায় তারা সামরিক শক্তি জড়ো করে। যৌথবাহিনী তাদের এড়িয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ঢাকার দিকে এগোতে থাকে। বাংলার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে।

এদিকে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরুর দিন পাকিস্তানিরা আরেক কৌশল অবলম্বন করে। যুদ্ধ থামাতে নেয়া হয় এ কৌশল। কারণ যুদ্ধ থামাতে পারলে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রগতি রোধ করা সম্ভব হবে।

একাত্তরের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উপস্থাপন করে। এতে দাবি করা হয়, এ মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তানকে নিজ নিজ সীমান্তের ভেতর সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন এ প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। বৈঠকের পর বৈঠক হলেও প্রস্তাবটি নিরাপত্তা পরিষদে পাস হতে পারেনি। এরই মধ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে দেয় ভারত।

এদিকে যুদ্ধের ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনী ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল। ভারতীয় জঙ্গি বিমানগুলো বারবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, চালনা প্রভৃতি এলাকার পাক সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। ঢাকায় বিমানযুদ্ধ মারাত্মক আকার ধারণ করে। প্রথম রাতের আক্রমণেই পাকিস্তানের বিমানবহরের প্রায় অর্ধেক বিমান ধ্বংস হয়ে যায়। ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর মিলিত আক্রমণ ও নৌবাহিনীর অবরোধে পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধের চিত্র পুরোপুরি পাল্টে যেতে থাকে।

আরও খবর
আরও
 ইউনিভার্স ট্রিবিউন