ছবি: সংগৃহীত

ব্যাংকিং খাতে কাঙ্ক্ষিত হারে কমছে না খেলাপি ঋণ। চলতি বছরের জুনের মধ্যে সব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে এবং পর্যায়ক্রমে তা ৫ শতাংশের নিচে নামানোর নির্দেশনা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তবে এখনও এর বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে অনেক ব্যাংকে। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতের দেশি এবং বিদেশি মালিকানার বেশ কয়েকটি ব্যাংক এই তালিকায় রয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংকে খেলাপি ঋণের বেশিরভাগই আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের স্থিতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৬৩ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। গত জুন প্রান্তিকে খেলাপি ছিল ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। সে হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ কমেছে ১ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে কমেছে শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশ।

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তিন মাস পরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের তথ্য হালনাগাদ করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। ব্যাংকগুলো থেকে পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। ব্যাংকগুলোর সাধারণত খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোর প্রবণতা রয়েছে। যে কারণে এ প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের চিত্র কম থাকলেও বাস্তবে তা আরও বেশি। কেননা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শকরা মাঠ পর্যায়ে তদন্ত গেলে অনেক ঋণকে তারা খেলাপি করার নির্দেশ দেন। যদিও এখন প্রায় বন্ধ রয়েছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসভিত্তিক ওই প্রতিবেদনটি সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অনুমোদন করেছেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নতুন করে কোনো ঋণ খেলাপি করা বন্ধ। এছাড়া ২ শতাংশ বিশেষ সুবিধায় খেলাপি ঋণ নবায়ন ও পরিদর্শনে গেলে সেখানেও নতুন করে কোনো ঋণ খেলাপি না করার পরোক্ষ নির্দেশনা দেয়া আছে। তাহলে কীভাবে খেলাপি বাড়বে। তবে প্রকৃত অর্থে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। বাইরে দেখা না গেলেও কার্পেটের নিচে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ লুকিয়ে আছে। যা ভয়ের কারণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ৪২ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা যা তাদের মোট ঋণের ২২ দশমিক ৪৬ শতাংশ, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ৪৫ হাজার ৩৭ কোটি টাকা যা তাদের মোট ঋণের ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ২ হাজার ৪৯ কোটি টাকা যা তাদের মোট ঋণের ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৫২০ কোটি টাকা যা তাদের মোট ঋণের ১৫ দশমিক ৯২ শতাংশ।

করোনার কারণে গত জানুয়ারি থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ রয়েছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সুবিধা বহাল থাকবে। ওই সময়ে কোনো ঋণকে নতুন করে খেলাপিও করা যাবে না। তারপরও ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমছে না কাঙ্ক্ষিত হারে। গত বছর খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করার পর থেকে কমতে শুরু করেছে। তবে ঋণ আদায় করে কমানো হচ্ছে না। কমছে বিশেষ সুবিদায় ঋণ পুনঃতফসিল করার কারণে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণ কিছুটা কমেছে। এটা যথেষ্ট নয়। নিয়মের কারণে যেহেতু খেলাপি ঋণ বাড়ছে না। সেহেতু এটা আরও কমা উচিত।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ওসমান আলী যুগান্তরকে বলেন, সবাই খারাপ ঋণগুলো আদায়ের চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে পুনঃতফসিলসহ বিভিন্ন উপায়ে মন্দ ঋণগুলো আদায় করতে পারলে ব্যাংকের স্থিস্তিপত্র পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমেছে। এটি আরও কমিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করছি।

জানা গেছে, অনিয়মের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোতেই বেশি হারে খেলাপি ঋণ রয়েছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে শতাংশ বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ এখন বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের। ব্যাংকটির এক হাজার ৪১৫ কোটি টাকা ঋণের প্রায় ৯৫ শতাংশের বেশি খেলাপি।

 

খেলাপি বিবেচনায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এক সময়ের ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে রূপান্তরিত আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। ব্যাংকটির ৮৪২ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ। মালিক পক্ষের জালিয়াতির কারণে ২০০৬ সালে ব্যাংকটি অধিগ্রহণ করে মালয়েশিয়াভিত্তিক আইসিবি গ্রুপের কাছে মালিকানা হস্তান্তর করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে অনিয়মের ঋণের বড় অংশই আদায় না হওয়ায় ব্যাংকটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। খেলাপি ঋণের দিক দিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নানা অনিয়মের কারণে আলোচিত সাবেক ফারমার্স ব্যাংক। এর পরিবর্তিত নাম পদ্মা ব্যাংক। এই ব্যাংকের ৫ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৬০ শতাংশের ওপরে এখন খেলাপি।

লুটপাটের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক রয়েছে চতুর্থ অবস্থানে। ব্যাংকটির ১৪ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৫০ শতাংশই এখন খেলাপি। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ২ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা ঋণের ৪০ শতাংশের বেশি খেলাপি।

এর পরের অবস্থানে রয়েছে সরকারি মালিকানার বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এক সময়ের শিল্প ঋণ সংস্থা ও শিল্প ব্যাংক মিলে বিডিবিএল করা হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ব্যাংকটির এক হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা ঋণের ৩৫ শতাংশের বেশি খেলাপি। বিশেষায়িত খাতের রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৫ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা ঋণের ৩০ দশমিক ৯৫ শতাংশ এখন খেলাপি।

পর্যায়ক্রমে সরকারি-বেসরকারি আরও অনেক ব্যাংকের অবস্থা এমন। সরকারের নির্দেশনায় মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য খেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়া হয়। যে কারণে গত বছর রেকর্ড ৫২ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়।

তারপরও খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানা সম্ভব তবে শুধু এই উপায়ে সীমাবদ্ধ না থেকে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আদায় জোরদার করতে বলা হয়েছে। এজন্য ১০০ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রতিটি ব্যাংকে আলাদা সেল গঠন করতে বলা হয়েছে।

আরও খবর
আরও
 ইউনিভার্স ট্রিবিউন